Friday 25 September 2015

সীমান্তের ইতিকথা - ‘তোমার ডাকে’


শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমি বরাবরই আমার চারপাশটা একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখার চেষ্ঠা করি, আমার কাছে পশ্চিমবঙ্গ মানে দার্জিলিং থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর নয়। আমার কাছে আমার শহর, আমার রাজ্য, আমার দেশ গোটা পৃথিবী জুড়ে। তাই যে চিৎকারগুলো বহুদূরে ভাসে, তা আমার কানে তীব্রভাবে বাজে । সেই তাড়না থেকে আমার থিয়েটার করা। আমার বাকি নাটকগুলোর মত ‘তোমার ডাকে’ সেই তাগিদেই সৃষ্ট।
প্রথম পর্যায় 
‘তোমার ডাকে’ নাটকটির প্রাথমিক কাজ শুরু হয় ২০১২ র মার্চ মাসে। রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি ক্লাসিক্যাল গল্প যেমন – ‘বিসর্জন’, ‘রক্তকরবী’, ‘ডাকঘর’, ‘অচলায়তন’, ‘মুক্তধারা’ নিয়ে শুরু হয় পথ চলা। চেষ্টা করি পাঁচটি নাটককে কিভাবে এক সুতোয় বাঁধা যায়। কাজটা নিঃসন্দেহে খুব কঠিন ছিল। আসলে এই নাটক গুলির মধ্যে আমি একটাই সুর খুঁজে পেয়েছিলাম। বেঁধে রাখা নিয়মগুলির বেড়া ভেঙে ফেলার ডাক। তৈরী করা নিয়ম যা শৃঙ্খলার পরিবর্তে বিশৃঙ্খল তৈরী করে, তাকে ছিঁড়ে বেড়িয়ে আসার ডাক। এই ক্রাইসিসগুলো আমরা ছড়িয়ে দিতে থাকি গোটা পৃথিবী জুড়ে। যদি বার্লিন ওয়ালকে সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথ মুক্তধারা লিখতেন অথবা হিরোসিমার ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে থাকত ডাকঘরের অমল। অথবা ছত্তিশগড়ের কোনো গ্রামে তৈরী হতে থাকে জয়সিংহের মত ম্যাসিস্ট কমরেড। এইভাবে শুরু হয় ভাবনা। সীমানার কাঁটাতার ভেঙে দিয়ে গোটা পৃথিবীর কান্না গুলোর একটা সুর খোঁজার চেষ্ঠা। আমরা নাটকটা শুরু করি মুক্ত আকাশে। গোটা অভিনয়স্থল কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা থাকত।তাতে ছেঁড়া অংশ জুড়ে অনবরত আগুন জ্বলত। সীমানার এপারে আমরা-আর ওপারে দর্শক। একটা সময়ে সবটা মিলেমিশে এক হয়ে যেত। নাটকটি হঠাৎই বন্ধ করে দিই| দর্শক নিতে পারেননি। খানিকটা দুর্বোধ্য লেগেছিল হয়ত...
দ্বিতীয় পর্যায় 
২০১২ – নভেম্বর মাস।হঠাৎ একটা লেখা চোখে পড়ল মালালা ইউসুফজাই কে নিয়ে। মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামসের এই লেখাটা আমায় খুব নাড়া দেয়। তালিবানদের দখলে থাকা পাকিস্তানের একটা ছোট গ্রামে ১০ বছরের একটি মেয়ের লড়াই। তালিবানরা তাকে গুলি করে। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় সে। তার হাত ধরে পুনরায় বেঁচে ওঠে ‘তোমার ডাকে’র প্লটগুলো। মালালার পদক্ষেপও আমাদের কাছে একটা ডাক। তার পাশে দাড়ানোর। এই সমগ্র ‘তৃতীয় বিশ্বের’ গুমরে থাকা নারীদের পাশে দাঁড়ানোর। অন্ধকার যক্ষপুরী থেকে তাদের মুক্তধারার স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার ডাক। শুরু হয় ‘তোমার ডাকে’র কাজ। এবার মঞ্চে করার উদ্দেশ্য নিয়েই। গোটা নাটকটা এক অন্য আদলে বাঁধা হয়। কিছু যুদ্ধের প্লট। তার সঙ্গে সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের আঙ্গিনায় তৈরী হওয়া হাজারো ভয়ানক পরিস্থিতি যা বাংলার রঙ্গমঞ্চে বসে আঁচ পাওয়া মুশকিল তা উঠে আসে। যেমন – ইরাক যুদ্ধ। জিম্বাবোয়ের খাদ্য সংকট, গুজরাটের বি.এস.এফ ক্যাম্প-এ নারী ধর্ষণ, পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদ, আন্দামান মুক্তি আন্দোলন, লিবিয়ার সাম্রাজ্যবাদী হানা ইত্যাদি। পাশাপাশি উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের চরিত্ররা| নাটকের প্রথম শো হয়েছিল আসাম ফেস্টিভালে।
তৃতীয় পর্যায় 
২০১৩ শেষের দিকে এই নাটকটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে আর্থিক সাহায্য পাই। ২০১৪ সাল - শুরু হয় নতুন ভাবনা। ‘তোমার ডাকে’ নাটকটি এতটাই কনটেম্পরারী যে প্রতিদিন তা পরিবর্তনশীল। নাটকের দিনেও নাট্যাঙ্গ সংযোজন হয়েছে। প্রতিদিন দর্শক নতুন নাটক দেখেছে। গঠন থেকে শুরু করে ঘটনা সবটাই বদলে ফেলি। আমার দলের ছেলেরা নাটকের মধ্যেই বাঁচতে থাকে। চারপাশে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলি আমাকে আরো বেশি করে তাড়া করতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে থিয়েটারের সব থেকে বড় শক্তি তার দর্শক – যারা নিজেদের গল্প শুনতেই হলে আসে। ভারতবর্ষের বাইরে তাদের কাছে পৃথিবীটা খুব গুরুত্বহীন। এটা আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা দর্শকের পরোয়া করিনি। তবুও দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছিল। এটাই আমাদের বড় পাওনা।
নাটকে মালালা ‘সূত্রধর’ হয়ে ওঠে। তারই মত তার প্রতিবেশী দেশগুলির লড়াইয়ের কথা বলে দেয় তার জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে। উঠে আসে এ এফ এস পি এ –এর অত্যাচার মনিপুরের শর্মিলার কথা, উঠে আসে সিবিয়ার শিশু সন্ত্রাসবাদীদের কথা উঠে আসে ইরাকি বারবনিতাদের প্রতিদিন ধর্ষিত হওয়ার কথা। উঠে আসে মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদ, পেন্টাগনের তৈরী হওয়া লালগড় ও ধংসের গন্ধ।
এই নাটকটি করার জন্য আমরা কিছুদিন কথাকলি, কলারী আর ছৌ এর ওয়ার্কশপ করি কারণ বিভিন্ন ফর্মেশনে আমরা নাটকটি দর্শকদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছি। কয়েকটি বই যেমন ‘আই অ্যাম মালালা’ ‘রেভলিউশনারী ইরান’ ইত্যাদি। আর বহু নথি-প্রবন্ধ আমায় তৃতীয় বিশ্বকে জানতে সাহায্য করেছে।
এইভাবেই ডাকঘরের অমল হয়ে উঠেছে গাজার এক ঘরছাড়া বালক।
জয়সিংহ এক তালিবানি সন্ত্রাসবাদী।
আর নন্দিনীরা মালালা।
আজও সময়ের সঙ্গ ধরে নাটক ‘তোমার ডাকে’ এগিয়ে চলেছে। যতদিন না আমাদের সমাজ কলুষমুক্ত হয়ে উঠছে, মঞ্চে প্রতিবাদ করব আমরা, এই আমাদের অভিপ্রায়।
ছবি সৌজন্যে : থিয়েটার সাইন ও অশোক নাইয়া

No comments:

Post a Comment