Monday 21 September 2015

আমার চোখে নাট্য মঞ্চ :- শ্রীকান্ত আচার্য্য (গায়ক)


শ্রীকান্ত আচার্য্য (গায়ক):
প্রথম বাড়ি থেকে আমাকে নাটক দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাসবিহারীর মুক্তাঙ্গনে। নাটকের নাম মনে না থাকলেও এটা স্পষ্ট মনে আছে সেই নাটকটি দেখতে দর্শক আসনে ছিলেন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়। তো নাটকের থেকে বেশি অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়কেই দেখেছিলাম । কিন্তু নাটক দেখতে যাওয়া সেটাই প্রথম। আসলে আমাদের পরিবারে নাটক দেখতে যাওয়ার ওরিয়েন্টেশন ছিল না। বাবা - মা নিয়মিত হাত ধরে নাটক দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন এমনটা কখনও হয়নি। সেটা গানের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। বরং নাটকের প্রতি ভালোলাগা ,ভালোবাসা আমার শুরু হয় স্কুল জীবনে। আমি তখন স্কুলে থিয়েটারে অভিনয় শুরু করি। মনে হয় ভালোই অভিনয় করতাম এবং তার জন্যই ওনারা আমাকে পাঠ দিতেন।
অভিনয়ের প্রতি দুর্বলতাটা আমার এখনও আছে। সেই জায়গা থেকে নাটকের প্রতি ভালোলাগা তো আছেই। নাটক দেখা শুরু হয় আমার স্কুল জীবনে। কিন্তু সেই জন্য অডিটোরিয়ামে গিয়ে নাটক দেখা ব্যপারটা ছিল না। আমি থাকতাম লেক গার্ডেন্স - এ। আমার পাশের পাড়াতেই পূজোর পরে সংহতি ক্লাবে থিয়েটার হত। পাড়ার জাঁদরেল লোকজন অভিনয় করতেন। 'শেষ থেকে শুরু' যে সিনেমাটি আছে সেটি তখন নাটকরূপে দৃশ্যায়িত হয়েছিল। পাড়ার সিনিয়র দাদারা এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন। আজও ভুলতে পারিনি সেই নাটক, এতটাই ভাল ছিল সেটি। তারপর দক্ষিন লেকপল্লীর মাঠেই উৎপল দত্ত পরিচালিত 'সাদা পোষাক' যাত্রা দেখলাম। ৭০ দশকের গোড়ার কথা বলছি। তখন কলকাতার রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব নাটকে প্রতিফলিত হত।
আমি পড়তাম যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুলে।এই স্কুলের গায়েই খুব বড় দূর্গা পূজা হত। এই পূজোর পরেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। ১৯৭৭-৭৮ সালের কথা বলছি। ওখানে প্রথম 'মারীচ সংবাদ' দেখি। পরবর্তীতে মাইলস্টোনের মত জায়গায় পৌছায় এই নাটকটি। আমি কিন্তু এই নাটকটি অ্যাকাডেমিতে গিয়ে পরে দেখেছি। তখন বিপ্লব কেতন চক্রবর্তী 'মেরি বাবা' চরিত্রে অভিনয় করতেন। থিয়েটার দেখার শুরুটা আমার তবে থেকেই। আকর্ষণটাও জন্ম নেয় সেই সময় থেকেই।
কলেজ ফেস্ট উপলক্ষে বেঙ্গল লিটারেট সোসাইটি থেকে অনেক নাটক হয়েছে। সেখানে অঞ্জন দত্তের মতো মানুষেরাও নাটক দেখতে এসেছেন। এইসব মানুষকে তখন প্রথম সামনে থেকে দেখেছি।
সে সময়ে আমার বন্ধু খরাজ মুখোপাধ্যায়, সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় 'চেনামুখ' জয়েন করে। 'চেনামুখ' আমাদের কাছে সাংঘাতিক একটা রোল মডেলের মত ছিল। রমাপ্রসাদ দা(বনিক)তখন পরিচালনা করেছেন। অনুসুয়া মজুমদারের মত অভিনেত্রী তখন অভিনয় করছেন। সুদীপ্ত, সুব্রতদা (অনুসুয়া মজুমদারের স্বামী), অসিত মুখোপাধ্যায়- এই সমস্ত তারকারা তখন মঞ্চ কাঁপিয়েছেন। 'রানী কাহিনী'- র মত নাটক আমি খুব কমই দেখেছি। ওরা তিনজন এই নাটকটিতে অভিনয় করেছেন।
ও, আর একটা কথা তো বলাই হল না। সেটা হচ্ছে স্কুলে যখন আমি সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে পড়তাম তখন নান্দীকারের 'ফুটবল' নাটকটি খুব জনপ্রীয় হয়েছিল। বাঙ্গুর পার্কে প্রথম দেখলাম 'ফুটবল' এবং তারপর অজিতেশ বন্ধ্যোপাধ্যায়ের 'সওদাগরের নৌকো'। আমি নির্দ্বিধায় বলছি, অজিতেশ বন্ধ্যোপাধ্যায়ের মত মানুষ, উনি মঞ্চে দাঁড়ালে যে কি ভোল্টেজ তৈরী হতে পারে তা সকলের কল্পনার অতীত। শম্ভু মিত্রের অভিনয় আমি দেখিনি। সেটা আমার দুর্ভাগ্য।
উৎপল দত্ত’র 'টিনের তরোয়াল'র দ্বিতীয় শেষ শো দেখেছি। এটা আমার পরম সৌভাগ্য। এই অভিজ্ঞতা গুলোর কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনা হয়না। আমি পরবর্তীতে অনেক নাটক দেখেছি ,কিন্তু এই ছোটোবেলার স্মৃতিগুলো অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে রয়েছে।
এরপর ১৯৮৪ –তে একটা খুব মজার ঘটনা ঘটেছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজ ফেস্টিভ্যালে প্রতি বছর কম্পিটিশন হত এবং গানের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় আমি কখনই খালি হাতে ফিরিনি। সে বছর সুদীপ্তর উদ্যোগে ওর লেখা একটা শ্রুতি নাটক 'মুখোমুখি' আমরা পাঠ করি। নাটকের মুখ্য চরিত্রে আমি অভিনয় করি। প্রেসিডেন্সিতে ফেস্টিভ্যালে সেই নাটক আমরা পাঠ করি। আমাদের বিপরীতে ছিল আমাদেরই বন্ধু ইন্দ্রাশিস লাহিড়ি ,মৃনাল প্রমুখরা। রুদ্র বাবু (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) বিচারকের ভূমিকায় ছিলেন। ওরা ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং আমরা সেন্ট জেভিয়ার্স। আমাদের মধ্যে খুব হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল। রুদ্রবাবু আমাদের বিজয়ী ঘোষনা করেন। এটা আমার জীবনের খুব বড় অ্যাচিভমেন্ট। এরপর নাটকের প্রতি ভালবাসা আরো বেড়ে যায়।
আমি আর একটা বিষয়ে খুব গর্ববোধ করি যে আমার প্রচুর বন্ধু থিয়েটার করে। চন্দন (সেন), কৌশিক (সেন), শান্তিলাল(মুখার্জী) এরা সকলে সিনেমা, সিরিয়াল এবং থিয়েটারে সমানভাবে অভিনয় করছে। এদের বন্ধু হিসাবে আমি গর্বিত।
এখনও মঞ্চে অভিনয় করতে বেশ একটা লোভ হয়। সুযোগ একবার এসেও ছিল। প্রায় বছর দশেকেরও আগে 'অ্যাপ্স' (অ্যাসোসিয়েশন ফর পারফর্মিং সিঙ্গারস্) -এর সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। তাঁদের উদ্যোগে ওয়েলফেয়ার রিলেটেড কাজকর্ম হতো। তখন একটি অ্যাম্বুলেন্স - এর উদ্দেশ্যে আমরা সকলে কোমর বেঁধে নেমেছিলাম। অরিন্দম গাঙ্গুলীর পরিচালনায় 'চলো পটোল তুলি' নাটকটা করেছিলাম। পরবর্তীতে খেয়ালী (দস্তিদার) এবং বেনু দা (সব্যসাচী চক্রবর্তী) এই নাটকটিতে অভিনয় করেছেন। তাতে আমি, ইন্দ্রনীল(সেন), শিবাজী(চট্টোপাধ্যায়), উৎপলেন্দু চৌধুরী , মানসী(সিনহা) সকলে অভিনয় করেছিলাম। নাটকটা প্রথমদিকে আমরা খুব অনিয়মিত রিহার্স করতাম। অরিন্দম অনেকদিন এসে বসে থাকত। লেক রোড - এ 'কনকসাঁঝ' নাম একটি দোকানের কাছে আমাদের রিহার্সাল হত। এদিকে রবীন্দ্রসদনে হল বুক হয়ে গেছে। একদিন অরিন্দম(গাঙ্গুলী) ডেকে আমাদের খুব বকাবকি করে। এরপর রিহার্সাল করে আমরা শেষমেষ নাটকটা মঞ্চায়িত করি। আমার এখনও মনে আছে বাইরে টিকিট ব্ল্যাক হয়েছিল। তারপর যেটা হল সেটা একেবারেই অভাবনীয়। কল শো আসতে শুরু করে। যদিও সেটা আর সম্ভবপর হয়নি। অদম্য ইচ্ছা থাকলেও তা গলার কারণে অবদমিত করেছি।
তবে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো করেই আমি শ্রুতি নাটকে অভিনয় করি। 'চিরকুমার সভা' করেছি অনেকে মিলে। বাইরেও শো করেছি। আটটি শো ইতি মধ্যে হয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে প্রচারের অভাবে অনেকে জানতেই পারেনি যে আমরা এরকম একটা প্রোডাকশন করেছি। বিভাস চক্রবর্তী, জগন্নাথ বসু, উর্মী বসু, লোপামুদ্রা মিত্র ও আমি এতে অভিনয় করেছি। এই আমার নিজস্ব নাটকের সঙ্গে সম্পর্ক।
যতদিন যাচ্ছে মানুষের এক্সপোজার তত বাড়ছে। এখানে একধরনের থিয়েটার হয়ে আসত। উত্তর কলকাতার কমার্শিয়াল থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে এসে একটা আন্দোলন হল। সেই নিয়ে তর্কও হল অনেক। সে থাকুক। ... কিন্তু তাতে বাংলার বর্তমান নাটকের যে চিত্র তাতে আখেরে লাভই হয়েছে।
বাংলার কমার্শিয়াল থিয়েটারের যে সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে তা নিয়ে আমি কি বলব, তা যাঁরা গবেষনা করেছেন তারা জানেন। কলকাতাতে নাটকের যা ইতিহাস কোথাও গিয়ে পরবর্তিতে তা বিলীন হয়ে যায়। তার অনেক কারণ থাকতে পারে। আমি এক সময়ে 'সারকারিনা', 'রঙমহল'-এ থিয়েটার দেখেছি। ভানু বন্ধ্যোপাধ্যায়, সন্তোষ দত্তের অসাধারণ অভিনয় দেখেছি। সেগুলো আর সম্ভবপর নয়। তবে বর্তমানে অ্যাকাডেমিতে ঘিরে নাটকের একটা পরিমন্ডল তৈরী হয়েছে। যাঁরা নাটকের সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাদের বেশির ভাগ মানুষেরই অভিযোগের যায়গা - নাটকের পরিকাঠামো, সুযোগ সুবিধার অভাব।
একটা হাই ওয়ে বানাতে গেলে দশ বছর সময় লাগতে পারে, কিন্তু সেটার ওপর দিয়ে ২০০ বছর মানুষ চলাচল করবে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা সেই দিকে মনোনিবেশ করতে চান না। তাতে তাদের ভোট পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে না যেহেতু। সেইরকম থিয়েটার স্টেজের একই অবস্থা। দরকার নেই ১০০০ দর্শকাসনের থিয়েটার হল বানানোর, তার বদলে যদি ২০০-৪০০ দর্শকের জন্যও থিয়েটার দেখার ব্যবস্থা থাকে কিন্তু, সেটা যেন ঠিকঠাক হয়। তার মেক-আপ রুম, লাইট, বাথরুম, এমারজেন্সি এক্সিট এগুলি যেন ব্যবস্থাপূর্ণ হয়। শুধুমাত্র কলকাতাতেই নয়, মফঃসলের ছোট হলগুলিতেও যেন সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেখানকার ছেলে মেয়েগুলিকে যেন কপাল চাপড়াতে না হয়, যে আমাদের কলকাতায় নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে না বলে সেটি কেউ দেখছেন না। আমার সৌভাগ্য হয়েছে কয়েকবার ব্রডওয়েতে থিয়েটার দেখার। তার স্টেজক্রাফ্ট, লাইট দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এর কোটি ভাগের এক ভাগও এখানে প্রদর্শিত হয় না। এই সুযোগ সুবিধা আমাদের এখানকার নাট্যকর্মীরা পেলে অনেক ভালো কাজ হতে পারে। আমি 'অঙ্গার' দেখিনি, 'চার অধ্যায়' দেখিনি, 'ব্যারিকেড' দেখিনি কিন্তু শুনেছি ভাঙা টিনের কৌটো দিয়েও লাইট তৈরী করেছেন তাঁরা।
কিন্তু নাটক করা কেউ বন্ধ করেনি। কলকাতার বাইরে মফঃসলে যেভাবে নাট্য চর্চা হয় তা অতুলনীয়। বালুরঘাটে হরিমাধব ভট্টাচার্যকে ঘিরে নাট্য চর্চা গড়ে উঠেছে। হাবরা অশোকনগর এই সমস্ত যায়গায় অসাধারণ কাজ হচ্ছে। তারা কি সব রাজা উজিরের সন্তান? তা নয়। তারাও ক্রাইসিসের মধ্যে আছে। কিন্তু আমার যেটা মনে হয় তারা এই যে ক্রাইসিসের মধ্যে আছে, সেই জন্যই হয়ত প্যাশন দিয়ে থিয়েটারটা চালিয়ে যাচ্ছে। এই জায়গা থেকে আমি তাদের টুপি খুলে সেলাম করি। ওই যে তাদের দেওয়ালে সারাক্ষণ পিঠ লেগে আছে, তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র অভিনয় দিয়ে তারা সবটা পুষিয়ে দেয়।
সব থেকে বড় কথা, সকলের মতামত আলাদা হওয়া দরকার। সকলে যদি একই সুরে কথা বলতে থাকে, তখনই বুঝতে হবে কিছু একটা গন্ডগোল আছে। কেউ নাটকের মাধ্যমে প্রতিবাদ করলে, অপরজনও পাল্টা নাটক করে প্রতিবাদ করুক। এতে নাটকই সমৃদ্ধ হবে। আমরাও ভালো নাটক দেখতে পাবো। এর আগে মতবিভেদ কি ছিল না! কিন্তু তাঁরা কি কখনও নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করেছেন? পরস্পরবিরোধী নাটক করেছেন? আমার তো মনে হয় করেননি। আর করেননি বলেই হয়তো একই সময়ে দাঁড়িয়ে নাটককে জয় করেছেন। সেটাই হোক। 'ওকে হল দেব আর তাকে দেব না' - এগুলো বন্ধ হোক।
কলকাতার নাটকের স্থানটা অনেক বড়। আমার এটা ভেবে ভালো লাগে যে গৌতম হালদারের নাটক থাকলে রবিবার দুপুর ৩টের শো-ও পর্যন্ত হাউস ফুল থাকে। থিয়েটারপ্রেমী মানুষজন ঠিক খবর রাখেন কোথায় কি হচ্ছে। আমরা যে খুব আরাম করে নাটকটা দেখতে পাই তেমনটাও নয়। কিন্তু সেই কষ্টটা আমরা মেনে নিই।
অনুলিখন : সৌমিতা গাঙ্গুলী
ছবি : অশোক নাইয়া

No comments:

Post a Comment