Monday 5 October 2015

আমার চোখে নাট্যমঞ্চ: অনিরুদ্ধ চাকলাদার (মেক আপ আর্টিস্ট)


টলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির চেনা মুখ অনিরুদ্ধ চাকলাদার। তিনি একজন মেক আপ আর্টিস্ট হিসাবে বেশ জনপ্রিয়। তবে তিনি যে নিয়মিত থিয়েটার দেখেন এ কথা হয়তো অনেকেই জানতেন না। এই না জানা কিছু কথাই তিনি ভাগ করলেন আমাদের সঙ্গে।

আমি খুব ছোটবেলায় ডান্স পারফর্ম করতাম। তখন আমি ইন্দোরে। কারণ আমি ইন্দোরে বড় হয়েছি। ওখানে থাকতে পুজোর চারদিন, বিভিন্ন কালচারাল অনুষ্ঠান হতো, সেখানে নৃত্যনাট্য করতাম। নাটক একবারই করেছিলাম। বাদল সরকারের নাটক। আমার একটা মেজর প্রবলেম ছিল। আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হত। নট লাইক অ্যাজমা, কিন্তু হতো। আর তখন ছোটো, ভয়েসটা পক্ত হয়নি। তাই আমি লিপ দিয়েছিলাম। আর ব্যাক স্টেজে অডিওতে অন্য একজনের ভয়েস চলেছিল। দ্যাট ওয়াজ দ্য অনলি প্লে,আই ডিড। এর পরে আর সুযোগ হয়নি। আমি ১৯৯৩তে কলকাতায় চলে আসি।

অনেকেই হয়তো জানেন না ,আমি নিয়মিত থিয়েটার দেখি। কলকাতায় আসার পর আমার অনন্ত দাস নামে একজন সিনিয়র মেক আপ আর্টিস্টের সঙ্গে দেখা হয়। ওনাকে আমি অ্যাসিস্ট করেছিলাম সন্দীপ রায়ের 'উত্তরন' ছবিতে। এই ছবির শুটিং এর আউটডোরে গিয়েছিলাম। সেখানে আলাপ হয় সৌমিত্র (চট্টোপাধ্যায়) কাকুর সঙ্গে। তখন আমি বেসিকালি অবজারভার ছিলাম। দেখতাম কিভাবে মেক আপ হচ্ছে না হচ্ছে। এই ভাবেই সৌমিত্র কাকুর সঙ্গে আলাপ পরিচিতি হয়। খুব স্নেহ করতেন উনি। তো সৌমিত্র কাকু বললেন যে "তুমি এখন কী করছ ? তুমি তো মেক আপ শিখতে চাও। আর মেক আপ যখন শিখতে চাও, তাহলে তোমার সব মিডিয়ামের মেক আপ জেনে রাখা উচিৎ। সিনেমার মতো নাটকেও কী ভাবে মেক আপ করা হয় সেটা গিয়ে দেখা উচিৎ। হয়তো তুমি নাটকে মেক - আপ করবে না কিন্তু কোনো একটা সিনেমায় নাটকের এন অ্যাক্টমেন্ট হচ্ছে বা কোনো বিজ্ঞাপনের কাজে নাটকের সিনারিও, সেক্ষেত্রে নাটকের মেক - আপ জেনে রাখাটা জরুরি।" আমি বললাম হ্যাঁ তা তো বটে। তখন সৌমিত্র কাকু 'দর্পন' (থিয়েটার গ্রুপ)-এ নাটক করছেন তপন থিয়েটারে। আমি টানা তিন মাস বৃহস্পতি - শুক্র - শনি, তপন থিয়েটারে যেতাম। ওখানে মহম্মদ আলি মেক আপ করতেন। আমি শো - এর আগেই পৌঁছে যেতাম। সৌমিত্র কাকুর ঘরে গিয়েই বসতাম। আলিদার মেক আপ অবজারভ করতাম। ওই নাটকে কৌশিক সেন লাবনী (সরকার)দি ছিল। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ঘর ছিল। সেখানে আলিদার সঙ্গে যেতাম। মেক আপ করা দেখতাম। তারপর থেকে ওই শনি - রবি ডবল শো হতো আর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যের শো। নিয়মিত যেতাম। যেহেতু তখন কোনো নির্দিষ্ট কাজ আমি করতাম না তখন সমগ্র শোয়ের মধ্যে নিজেকে নিযুক্ত রাখতাম। মেক - আপ ছাড়াও,মঞ্চ কী ভাবে তৈরি হচ্ছে,কী ভাবে চেঞ্জ করা হচ্ছে সবই দেখতাম। তখন ১৯৯৩। কলকাতায় আসার পরেই। যাই হোক আলিদার সঙ্গে থাকতে থাকতে ওনার সঙ্গেও একটা ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। তো আলিদা যেখানে যেত, এই গিরীশ মঞ্চে, রবীন্দ্রসদনে, মধুসূদন মঞ্চে, আমি সেখানেই পৌঁছে যেতাম। কোন কোন নাটক হতো সেই সময় আমার মনে নেই। তবে আমি যেতাম, মেক আপ দেখতাম, মঞ্চসজ্জা দেখতাম, নাটকও দেখতাম। আমার ছোটো পিসি নাটকের সঙ্গে ভীষণ ভাবে যুক্ত ছিল। আমি তখন নিয়মিত থিয়েটার দেখতাম। এখনও দেখি।

এখন বন্ধু বান্ধবদের করা সব নাটকই দেখি। এই যেমন চান্দ্রেয়ীর (ঘোষ) করা করা 'চতুষ্কোণ' দেখলাম। ব্রাত্যও (বসু) ছিল নাটকে। নাটকটা খুব সুন্দর হয়েছিল। এখন ব্যাপারটা হচ্ছে যে, হলে গিয়ে টিকিট কাটা খুব সমস্যা, তাই বন্ধু বান্ধবদের নাটক হলে তারা ডাকেন বলে 'টিকিট রেখে দেব কবে আসবে ?'

এই যেমন স্বপ্নসন্ধানীর নতুন কোনো নাটক হলে রেশমী (সেন) ফোন করে বলে 'অনিরুদ্ধ টিকিট রেখেছি এসো।' আমি স্বপ্নসন্ধানীর প্রায় সব নাটকই দেখেছি। সম্প্রতি পাওলির (দাম) সঙ্গে অঞ্জন (দত্ত) দার 'অবনী অপেরা' দেখতে গিয়েছিলাম। তারপর আগে তনুশ্রী (চক্রবর্তী) বললো 'চলো 'গ্যালিলিও' দেখে আসি।' তারপর অর্পিতার (ঘোষ) 'নটীর পুজো' দেখলাম।

আগের আগের বছর গিরীশ মঞ্চে অরুণ মুখার্জীর একটা নাটক দেখেছিলাম। ওই নাটকে আমার বন্ধু সৌরভ চক্রবর্তী ছিল। নাটকটির নাম ছিল 'এলা ও বিমলা'।

এরকম ভাবে নাটক দেখাই হয়। ভালো লাগে। অডিয়ন ফেস্টিভ্যালে কঙ্কনার (সেন) 'ব্লু মঙ্ক' দেখতে গিয়েছিলাম।

এখনও পর্যন্ত আমি নাটকের কোনো মেক আপ করিনি। নৃত্য নাট্যতে কাজ করেছি। যেমন - মধুবনীর প্রত্যেকটা প্রজেক্টে আমি লুক প্ল্যানিং করেছি। নন্দিনীর 'রক্তকরবী'র লুক প্ল্যানিংকরলাম। রঙ্গনাদির 'অন্য আমি' তে কাজ করেছি।

সুদীপ্তা (চক্রবর্তী) যে নাটকে কাম ব্যাক করেছিল, ওই নাটকটা দিয়ে স্টার থিয়েটার ওপেন হয়েছিল। ওই নাটকটার জন্য সুদীপ্তার পোর্টফোলিও করেছিলাম।
এছাড়া 'স্বপ্নসন্ধানী' নাট্যদলের 'প্রথম পার্থ' দেখেছিলাম যখন রজতাভ (দত্ত) কর্ণের চরিত্রটি করত। এটা দেখেছিলাম মধুসূদন মঞ্চে। আমার ম্যাকবেথ খুব ভালো লেগেছে। নাটকটির প্রোডাকশন ভ্যালু অসাধারণ। আমার কৌশিকের পরিচালনা এবং অভিনয়ের মধ্যে অভিনয়টা বেশি ভালো লাগে। তাই কৌশিককে বলি তুমি ক্যামেরার সামনেই থাকো। তবে কৌশিকের প্রায় সব নাটক দেখেছি বলেই এই কথাটা বলতে পেরেছি। ধরাবাহিক ভাবে কোনো কিছু না দেখলে স্টেটমেন্ট দেওয়া যায় না বা কমেন্টও করা যায় না।

যখন পুনাতে ট্রেনিং এ ছিলাম তখন শাবানা আজমি এবং ফাহরুখ শেখের 'তুমহারি অমৃতা' দেখেছিলাম। আমার দেখা সেরা নাটক এটি । মঞ্চের উপর দুজন মানুষ নমস্কার করে চেয়ারে বসলেন। এক দিস্তা কাগজ টেবিলের ওপর রাখা। ওগুলো চিঠি। একটা করে তুলছেন আর পড়ছেন, পড়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন। একটা অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। ওরকম অভিজ্ঞতা আমার আর হয়নি। কিছুটা দেখার পর আমি চোখটা বন্ধ করে নিলাম। শুধুমাত্র সংলাপ শুনলাম । এটা শুধুমাত্র পারফর্মেন্স নয়, অসাধারণ কনসেপ্ট ছিল।

অনুলিখন : রেশমী পাল 
ছবি : প্রতীক ব্যানার্জী

No comments:

Post a Comment